ইসলাম ও মুসলমানের দেশ ‘বাংলাদেশ’


                    তথ্যবহুল জ্ঞানসমৃদ্ধ আলোচনা আপনিও জেনে নিতে পারেন।


  শফিকুল ইসলাম : ইসলাম মানবতা ও সাম্যের ধর্ম’-যার উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বভিত্তিক সাম্য, শান্তি, নিরাপদে সহাবস্থানএ ঐতিহ্যের পথ ধরে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেইসলাম ও মুসলমান এদেশ অবিচ্ছেদ্য ধারণা-একটি সাহসী জনগোষ্ঠি ও জনপদের নামতাই এখানে নগর-বন্দর নামকরণে আরবি-ফারসির যোগসূত্র লক্ষণীয়সাবাউরথেকে সাভার, ‘বার-হিন্দথেকে বরেন্দ্র, ‘আদখুলনাথেকে খুলনা, ‘সাবত-ই-গাংথেকে চট্টগ্রাম বা ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, মৌলভীবাজার ইত্যাদির নামকরণ আর ইসলামাবাদ, জালালাবাদ, নাসিরাবাদ সবই মুসলিম ঐতিহ্য ও বিজয় স্মারক হিসেবে সমুজ্জ্বল
৬১৭ খ্রি. ১৪ রজব বৃহস্পতিবার প্রিয় নবীর (সা.) আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দুভাগ হতে দেখে রাজাভোজমুসলমান হয়ে আব্দুল্লাহ নামধারণ করেন এবং ইনিই ভারতবর্ষের প্রথম মুসলমান আর এজন্যই এদেশের মুসলমানদের বলা হয় রাজার জাতএতে বোঝা যায় প্রিয়নবীর (সা.) জীবদ্দশায় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়অন্যদিকে বিবি খাদিজার (রা.) বাণিজ্যিক জাহাজ চট্টগ্রামে নোঙ্গর ফেলেছিল এবং দক্ষিণ আরবের সাবাজাতি ঢাকার অদূরে বসতি গড়লে তার নাম হয়ে যায় সাভার
বাংলাদেশের সমাজ মসজিদভিত্তিক এবং ইসলাম ও মুসলিম চেতনায় মসজিদ স্থাপত্যকালের সাক্ষী হয়ে আছেরংপুরের ৪৮ কি.মি. দূরে লালমনির হাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে ৬৯ হি. (আনুমানিক ৬৯২ খ্রি.) বাংলাদেশের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়অন্যদিকে বিশিষ্ট সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৩য় হি. (৬২৬ খ্রি.) ইসলাম প্রচারের জন্য চীন যাওয়ার পথে কিছুকাল রংপুর এলাকায় অবস্থান করে ইসলাম প্রচার করেনকেননা, যুগে মিশর থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত নৌপথে আরবগণ মালাবরউপকূল হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেনতাদের প্রভাবেই সাবত্-ই-গাংথেকে চাটগামবা চট্টগ্রাম শব্দের বিকাশএদেরই একদল উজানে নৌপথে যাত্রা করে হিন্দুস্থানের স্থল ভূমির সন্ধান পেয়ে বলে ওঠে বার হিন্দযারই রূপান্তর বরেন্দ্র অঞ্চল
সাহাবি, পীর দরবেশের দাওয়াতি মেহ্নতে এ অঞ্চলের মানুষ আজ উন্নত গুণমানের মুসলমানআমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে মামুন, মুহাইমেন (রা.) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেনএছাড়াও এ উপমহাদেশে আগত সাহাবিদের মধ্যে রয়েছেন- আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল্লাহ্ ওতবান, আশইয়াম বিন আমর তামিমি, মামার তামিমি প্রমুখতাদের অনেকে গ্রামে বাস করতেন এবং এদেশের ভাষা শিখে নিয়ে অল্প সংখ্যক খাঁটি মুসলমান তৈরি করে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় তাবলিগের কাজ করতেন
পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতায় অসংখ্য গুণী দরবেশের পদস্পর্শে এদেশে ইসলাম ও মুসলমানের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়যার উল্লেখযোগ্য হলেন- শাহ্ সুলতান বল্খি রহ. (১০১৪ খ্রি.) বগুড়া, শাহ্জালাল রুমি রহ. (১০৫৩ খ্রি.) বৃহত্তর ময়মনসিংহ, শাহ্মাখদুম রূপোস রহ. (১১৮৪ খ্রি.) রাজশাহী, শাহ্ জালাল রহ. (১৩০৩ খ্রি.) সিলেট, খান জাহান আলী রহ. (১৪৩৭-১৪৫৮ খ্রি.) খুলনায় ইসলাম প্রচার করেনএছাড়াও শাহ্ আমানত রহ., শাহ্ বদর রহ., শাহ্ আলী বাগদাদি রহ. (১৪৮৯ খ্রি.), শারফুদ্দিন আবুতাওয়ামা রহ., বায়জিদ বোস্তামি রহ., শেখ বোরহানুদ্দিন রহ. প্রমুখ এদেশে জাগিয়ে ছিলেন তাওহিদি চেতনা এবং ঈমানি শক্তির উজ্জ্বল শিখা
অন্যদিকে ৭১২ খ্রি. মুহাম্মদ বিন কাশেম সিন্ধু জয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ইসলামের রাজনৈতিক জয়যাত্রা শুরু হয়ফলে ১২০৪-০৫ খ্রি. বখতিয়ার খিলজি সতেরো জন অশ্বারোহী নিয়ে বিনা বাধায় বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেনএ সময়েই ১২০৬ খ্রি. এর ২৪ জুন কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হনমুসলমানদের এ বিজয় যাত্রা ও শাসন সাড়ে পাঁচশ বছর স্থায়ী হয়েছিল (১২০৪- ১৭৫৭ খ্রি.)
ঢাকার সোনারগাঁয়ে শায়খ শারফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. (মৃ. ৭০০ হি., ১৩০০ খ্রি.) হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠ দান শুরু করেনবলা চলে এখানেই বাংলাদেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক হাদিস চর্চা শুরু হয়
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার-প্রতিষ্ঠার অবিস্মরণীয় নাম হযরত শাহ্ জালাল রহ. (মৃ. ৮১৫ হি., ১৪১১ খ্রি.)তিনি ৭০৩/ ৭০৪ খ্রি. সিলেট জয় করেনতার ৩৬০ জন সঙ্গীর সবাই ছিলেন উচ্চ মর্যাদার দরবেশতারাই এদেশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বিপ্লবের ধারাকে বেগবান করেন তাইতো আজো সুরমা পাড়ে অনুরণিত হয়-সিলট পরথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছেন... তোরা শোন সেই আজান ধ্বনি আইজো হইতাছে
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের অমর ব্যক্তিত্ব খান জাহান আলী রহ. (মৃ. ৮৬৩ হি., ১৪৫৮ খি.)তিনি খুলনা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন এবং বাগেরহাটে ইন্তেকাল করেনতাঁর ডড়ষফ যবরঃধমব ( বিশ্ব ঐতিহ্য ) খ্যাত ষাট গম্বুজমসজিদসহ অসংখ্য অমর কীর্তির গুণে ইসলাম ও মুসলমানের প্রিয় স্বদেশ হয়ে ওঠে বাংলাদেশবন-বনানী বেষ্টিত সুন্দরবন অঞ্চলে তারই প্রতিষ্ঠিত রাজ্য খলিফাতাবাদেপ্রবেশের স্মারক উচ্চারণ আদখুলনা বা আমরা প্রবেশ করলামথেকে অঞ্চলটির নামকরণ করা হয় খুলনা অন্যমতে দুষ্ট জ্বিনরা যখন নোঙ্গর করা জাহাজ খুলে দিত তখন খান জাহান আলী রহ. ধমক দিয়ে বলেছিলেন খুলনাএ থেকেই খুলনা নামকরণ
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে যাওয়া সাধক ও শাসকের তালিকা সুদীর্ঘ, যা আলোচনার সুযোগ-সামর্থ্য আমার নেইতবু কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি কয়েক জনকে, যেমন হাজি শরিয়তুল্লাহ্ রহ. (১১৮৬-১২৪৫ হি., ১৭৭৯-১৮৩৮খ্রি.) মাওলানা কারামতুল্লাহ্ জৈনপুরী রহ. (১২১৫-১২৯০ হি., ১৮০১-১৮৭৩ খ্রি.) শাহ্নেয়ামতুল্লাহ্ রহ. (মৃ.১৭০০ খ্রি.), মাওলানা. শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., মাওলানা আতাহার আলী রহ., মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব পীরজী হুজুর রহ., মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগড়ি রহ. (চীন), মাওলানা সৈয়দ আমিমুল ইহসান রহ., মুফতি দ্বীন মুহাম্মদ খাঁ রহ., মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ্ হাফেজ্জী হুজুর রহ., আল্লামা আজিজুল হক রহ. প্রমুখএছাড়াও সমসাময়িক আরো কয়েক জন রয়েছেন যারা একেক জন উজ্জ্বল নক্ষত্রের দ্যুতি ছড়িয়ে স্বনামেই খ্যাত এবং তাদের ঋণ অপরিশোধ্য
বস্তুত ইসলাম ও মুসলমানের নিরাপদ ও শান্তির প্রিয় আবাসস্থল বাংলাদেশএখানে সমাজ, রাজনীতি, আইন-দর্শন তথা জীবনের সবখানে বা যেখানে যখন যতটুকু প্রয়োজন ইসলাম সেখানে ততটুকুই নিয়ন্ত্রক ও নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেএমন কি লোক সাহিত্যেও এটি আছে-
পশ্চিমে বন্দনা করলাম মক্কা এন (হেন) স্থান
উরদিশে (উদ্দেশ্যে) বাড়ায় ছেলাম (হাত বাড়িয়ে সালাম) মুমিন মুসলমান...
চাইর কুনা পিরথিমি (পৃথিবী) গো বইন্ধা (বন্দনা করে) মন করলাম স্থির
সুন্দরবন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর
(
মৈমনসিংহ গীতিকা মহুয়াপালা)


No comments:

Powered by Blogger.