চরমোনায়ের পীর সাহেব

বই এর নামঃ চরমোনায়ের পীর সাহেব আমাকে জামায়াতে ইসলামীতে নিয়ে এলেন।

লেখিকাঃ মাসুদা সুলতানা রুমী
প্রকাশকঃ shafiqultutorial.com


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম 
-----------------------------------

কি করে এ পথে এলেন? প্রায়ই এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মাঝে মাঝে খুব কস্ট পাই এই প্রশ্ন শুনে। হায়! আফসোস! এক মুসলমান আর এক মুসলমানকে জিজ্ঞেস করছে কি করে খাঁটি মুসলমান হলাম? অথচ আমরা কেউ নও মুসলিম নই। সবাই বংশানুক্রমে মুসলমান।
অবশ্য জিজ্ঞেস করার পিছনে কারন আছে। কারন মুসলিম শব্দটা এখন কুয়াশাবৃত। কে কেমন মুসলমান এটা বুঝতে হলে এখন তিনটি শব্দ প্রয়োগ করতে হয়। 
১> সাধারন মুসলমান ২> আল্লাহওয়ালা মুসলমান ৩> মৌলবাদী মুসলমান

১> সাধারন মুসলমান তারা যারা সময় পেলে মাঝে মাঝে দু'চার ওয়াক্ত নামায পড়ে। রমযানের রোযাও রাখে। বিয়ে, খাতনা, আকীকা, জানাজা মুসলমানি পদ্ধতিতে করে। দান খয়রাতও করে। আবার বিনা প্রয়োজনে নামায রোযা ছেড়েও দেয়। অবশ্য ইসলামের অন্যতম ফরজ পর্দা পালন করে না। মহাজাকজমকের সাথে কুলখানি, মিলাদ মাহফিল, নফল ইবাদত, বিশেষ করে শবে বরাত ও ঈদ উদযাপন করে এবং আমরা ধর্মান্ধ নই বলে গৌরব করে। এরা রাজনৈতিক ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী।এরাই আমাদের সমাজে সাধারন মুসলমান নামে পরিচিত। 

২> আল্লাহওয়ালা নামে পরিচিত তারা যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, নফল ইবাদতসমুহ আদায় করে, রমযানের ফরজ রোযার পর অন্যান্য নফল রোযাও রাখে, মোটামুটিভাবে পর্দা করে, জিকির আজকার ও তসবিহ-তাহলিলও করে। লম্বা আজানুল্বিত জামা পড়ে। তবে এরা আধুনিক শিক্ষাকে ঘৃণার চোখে দেখে। রাজনীতি ও সামাজিক কাজগুলোকে ঝাক্কি-ঝামেলা ও ফেতনা-ফেসাদ মনে করে। এরা কারও সাথে তেমন একটা মিশতে চায় না। কারও সাতে-পাচে এরা নেই। অবশ্য কেউ চাইলে পানি পড়া, তেল পড়া ও ঝাড়ফুঁক করে থাকে। এরা অনেক ক্ষেত্রে সমাজে সম্মানের পাত্র। এরাই সমাজে আল্লাহওয়ালা নামে পরিচিত। 

৩> তৃতীয় দলটা হচ্ছে মৌলবাদী। এরা সব ধরনের ফরজ, ওয়াজিব এবং প্রয়োজনীয় নফল ইবাদত বন্দেগীর সাথে সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত। আল্লাহর জমিনে আল্লহর আইন কায়েম করার কাজে তৎপর। শুধু ঢিলা-কুলুপ আর মিষ্টি খাওয়া সুন্নত নিয়েই এরা ব্যস্ত থাকে না। এরা রাসুল (সঃ) এর বিপ্লবী জীবনকে পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে চায়। সমস্ত বাঁধা- বিপত্তিকে উপেক্ষা করে এরা সমাজ থেকে উচ্ছেদ করতে চায় সকল প্রকার বিদাতী ও শিরকী কার্যক্রম। কায়েম করতে চায় পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর আইন। এরা শুধু নামায আর যাকাত আদায় করেই তৃপ্তি পায় না। এরা নামায ও যাকাতকে সমাজে কায়েম বা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। শুধু নেকীর আশায় কোরআন তেলাওয়াত করে না আর চুমু খেয়ে তাকের উপর তুলে রাখে না। এরা কোরআনকে দেখতে চায় সংবিধানরুপে। কোরআনের আইন দেখতে চায় সমাজের সর্বত্রই- মসজিদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। 

তাই সমাজের কায়েমী শক্তি এদের শত্রু। সাধারন মুসলমান এমন কি আল্লাহয়ালা নামে পরিচিত কিছু মুসলমানও এদের সঙ্গে সত্রুতা করতে পিছপা হয় না। কারন ইসলাম কি এবং কাকে বলে এর সুস্পষ্ট ধারনা বর্তমান বিশ্বের বারো আনা মুসলমানের নেই। এই শেষোক্ত দলটির সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ইসলামের পুরনাংগরুপ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের মতো ইসলাম যে কেবল আচার- অনুষ্ঠান ভিত্তিক ধর্ম নয়, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ বিপ্লবী মতাদর্শের নাম। যে মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে পাওয়া যাবে খলাফায়ে রাশেদার মত একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ। এই দলটি এ কথা বিশ্ববাসীকে বঝাতে চাচ্ছে সর্বক্ষণ। 
আর এতে আঘাত লাগছে যাদের স্বার্থে তারাই ঠাট্টা বিদ্রূপ আর গালাগালির ভাষায় এদের নাম দিয়েছে মৌলবাদী। কিন্তু এই নামকরনে এরা অসন্তুষ্ট তো নয়ই বরং খুশি। যেমন আমি নিজেকে মৌলবাদী ভাবতে গর্ববোধ করি। ধন্য মনে করি নিজেকে এই দলের একজন সামান্য কর্মী হতে পেরে।
তাই যারা প্রশ্ন করেন কি করে এ পথে এলেন? তারা জানতে চান না কি করে আমি একজন খাঁটি মুসলমান হলাম। তারা জানতে চান, কি করে মৌলবাদী হলাম? আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, কি করে জামায়াতে ইসলামীতে এলাম???


আমরা একটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তখন প্রায় প্রতিরাতেই ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়িতে খাওয়া- দাওয়া ও সেবা যত্নের জন্য অবস্থান করতেন। সে সময় আম্মাকে সাহায্য করেছি রাত জেগে। 

আব্বা এবং মুক্তিযোদ্ধা কাকুরা যা কিছু আলোচনা করতেন আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তাদের আলোচনা সমালোচনা শুনে ধীরে ধীরে জামায়াতে ইসলামী বিরধী মনোভাব নিয়েই বড় হয়ে উঠলাম। তাই বলে ইসলাম বিরোধী হয়ে নয়। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ধারনা হল এইযে, এরা একটা রাজনৈতিক দল। এরা মুখে ইসলামের কথা বলে কিন্তু কার্যত ইসলাম বিরোধী কাজ করে। আর অধ্যাপক গোলাম আযম তো এদেশের সব চেয়ে নিকৃষ্ট একটা মানুষ।পক্ষান্তরে আর একটি ব্যক্তিত্ব আমার কিশোরী মনের সিংহাসনে শ্রদ্ধা ভক্তির পূর্ণ প্রতীক হয়ে জেঁকে বসেছিলেন। তাকে নিয়ে যখন সুরেলা কন্ঠে গাইতাম "তুমি বাংলার চির সম্রাট/ অন্ধকারের শশীরে মুজিব ...... ", তখন মনের আবেগে চোখ পানি এসে যেত।

শেখ মুজিব যখন পাকিস্থান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এলেন, তখন আমার মা এবং দাদী শোকরানা রোযা রেখেছিলেন। তাকে ভালবেসেছিলাম হৃদয়ের সমস্ত ভক্তি শ্রদ্ধা দিয়ে। আমাদের বাসার কাজের বুয়া কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিল, আগে ভালোই ছিলাম গো আম্মা। এই মজিবরই তো দেশটারে খাইলো। তার কথা শুনে আমি রাগে দুঃখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তখনি আম্মাকে ডেকে বললাম, "আম্মা এই বেয়াদব মহিলাকে বাসায় রাখা যাবে না। শুনে মহিলা তো অবাক। "কেন গো আম্মা, আমি কি দোষ করলাম?", চুপ কর! তুমি এইভাবে নামটা উচ্চারন করলা কেন? মহিলা আবার বলল " মজিবরকে মজিবর বলব নাতো কি বলব? আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম, 'চুপ বেয়াদব মহিলা। উনাকে বঙ্গবন্ধু বলবে, শেখ সাহেব বলবে" মহিলাকে শেষ পর্যন্ত বিদায়ই করে দিলাম। শেখ মুজিবকে কতো যে ভালবেসেছিলাম তা বলে বুঝাতে পারবনা।  

আমাদের পরিবারে নামায রোযা ছিল। আব্বা -আম্মা, দাদা-দাদী পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাবন্দ ছিলেন। আমরা ছোটরাও সময় সুযোগ মতো নামায পড়তাম। কিন্তু পর্দার ব্যাপারটা ছিল অন্য রকম।
ঘরোয়া পর্দা মানে গায়ের মহরম আত্মীয়- স্বজনের সাথে পর্দা তো ছিলনই না, বাইরের পর্দাটাও ছিল এ রকম, আম্মা যখন আমার দাদা বাড়ি থেকে আমার নানা বাড়ি যেতেন তখন বোরকা পড়তেন। দাদা বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মাইল বাসে যাওয়ার পর নৌকায় যেতে হতো। এরপর নৌকা থেকে নেমে মাইল খানেক হেঁটে মামার বাড়ি যেতে হতো। তো আম্মা ঐ নৌকা থেকে নেমে আর বোরকা পড়তেন না। কারন এটা ছিল আম্মার বাপের বাড়ির এলাকা। আবার ফিরে আসার সময় এর বিপরীত করতেন। নৌকা থেকে নামার পূর্ব মুহূর্তে বোরকা পড়তেন। কারন তখন শুরু হয়ে যেত আম্মার শ্বশুর বাড়ির এলাকা। 
আমি ভাবতাম বোরকা হচ্চে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পোশাক। আমি আমার ফুফু আম্মাকেও এমনি দেখেছি। ইসলামের উপর মহব্বত ছিল কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না আমরা। ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো সবাই পালন করার চেষ্টা করতেন। নফল রোযা, নফল নামায, শবে বরাত, শবে মিরাজ, শবে কদর খুব জাঁকজমকের সাথে পালন করতাম। নফল ও ফরযের পার্থক্য কমই বুঝতাম। তারমানে আমাদের সমজের অন্য দশটা ধর্ম নিরপেক্ষ মুসলিম পরিবার যেমন ঠিক তেমনি একটি পরিবারেই আমি জন্ম নিয়েছি। শৈশব কৈশোর পার করে বাইশ বছর বয়সে আমার জীবনের আমূল পরিবর্তন আসে।
 (চলবে)

No comments:

Powered by Blogger.