সমাজে জুম্মার খুতবার প্রভাব কেমন পড়ে

মসজিদ আল্লাহর ঘর। পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফের জুমার খুতবার অনুসরণে পৃথিবীর সব মসজিদে খুতবা পেশ করেন ইমাম ও খতিবরা। নির্যাস কুরআন ও হাদিসের বাণীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে খুতবা রচনা ও পাঠ করা হয়ে থাকে। কোনো খতিব বা ইমামের ইচ্ছা করে নিজের মনগড়া বক্তব্য পেশ করার শরয়ি কোনো বিধান নেই। সমসাময়িক সমস্যা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি খতিবরা সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষের উপকারার্থে জুমার খুতবায় পেশ করে থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকার লালবাগ মসজিদ, মসজিদে গাউসুল আজম, চকবাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ, গুলশান জাতীয় মসজিদ, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ উল্লেখযোগ্য। এ সব মসজিদে কখনো দেশ, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য খতিবরা দিচ্ছেন বলে আমাদের জানা নেই। সব মসজিদের খতিব কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানে জ্ঞানার্জন করে মসজিদে বক্তব্য পেশ করার জন্য উপস্থিত হন। ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন, কুরআন ও হাদিসের বাইরে কোনো বক্তব্য তারা এ ক্ষেত্রে রাখেন এমন ধারণা ও বক্তব্য আমরা শুনিনি।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুধু তাদের বক্তব্যে উত্তেজনা বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে এমন ধারণা ঠিক নয়। কোনো ইমাম-খতিব চান না সমাজ, রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি লেগে থাকুক বা বিশৃঙ্খলা হোক। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার উপদেশ দেন খতিবরা। তাদের বক্তব্যের কারণে সমাজ কখনো বিপথগামী হবে এ ধরনের বক্তব্য তারা রাখতেও পারেন না। তারা মসজিদ, সমাজ, আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর কাছে দায়বদ্ধ। কখনো তাদের পক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কোনো বক্তব্য পেশ করা সম্ভব নয়। সমাজে গুণে জ্ঞানে যারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র, তারাই মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অনেক বিষয় বিবেচনা করে কমিটির সদস্য ও আলেমরা খতিব নির্বাচিত করে থাকেন। 
সহজ ও সরল প্রকৃতির এসব সমাজশ্রেষ্ঠ মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বক্তব্য রাখেন সমাজের অন্য শ্রেণী ও পেশার মানুষ। আসলে কোন জায়গায় গলদ, কেনইবা এ ধরনের বক্তব্য আসছে সেটাও রাজনৈতিক, সমাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে চিন্তায় আনতে হবে। দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ-অকল্যাণ পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বিদ্যমান। এসব বাণী ও উদ্ধৃতি মসজিদের খতিবরা তাদের সাপ্তাহিক খুতবায় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। মানবজাতিকে তারা সঠিক ও সহজ-সরল রাস্তা পরিচয় করানোর চেষ্টা করে থাকেন বলেই তারা হয়েছেন ‘ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া’।
প্রকৃতপক্ষে নির্ভেজাল ও বিজ্ঞ ওলামায়েকেরামরাই হচ্ছেন নবী-রাসূলদের উত্তরসূরি। নবী-রাসূলদের যে মিশন ছিল, ওলামায়ে হক্কানির সেই মিশন। এখানে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আজকের দুনিয়ায় নবী-রাসূলগণ জীবিত নেই। আছে তাঁদের কালজয়ী আদর্শ, পথনিদর্শন। সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর মহান শ্রেষ্ঠ আদর্শ, উন্নত চরিত্র তাদের পাথেয়। তাদের যুগশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেন তারা। অনুরূপভাবে আছে মহান চার খলিফার উন্নত জীবনাদর্শ। এক কথায় ইসলামের উজ্জ্বল জীবনবিধান কালজয়ী আদর্শ, মানবতার মুক্তির শ্রেষ্ঠ সনদ। এ মহান আদর্শের ধারক-বাহক মসজিদের খতিব ও ইমামরা। তারা কখনো নিজের জীবন-জীবিকার তাগিদে কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতা বা দলীয় চিন্তায় কখনো ইসলামের নীতি-নৈতিকতার সাথে আপস করেন বলে বিশ্বাস হয় না। তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় সাধনা ইসলামের খেদমতে ব্যয় করতে দেখা যায়। তাদের বক্তব্য খুতবায় কখনো সমাজ পিছলে পড়ে না। তারা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে শেখাচ্ছেন। বিভাজন তারা দেখাতে চান না। সব মানবতার ঐক্য, শান্তিশৃঙ্খলা ও মমত্ববোধ তাদের উদ্দেশ্য ও মিশন।
আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে কেন তাদের বক্তব্য-আলোচনার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, সেটা বুঝতে এখন আর তেমন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ তারা যেভাবে সমাজবিশুদ্ধ সন্ত্রাস, জঙ্গিমুক্ত রাখার জোরালো বক্তব্য দিতে পারেন, আর কেউ এ ধরনের বক্তব্য ও ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাই তাদের বক্তব্যকে অনেকের ভালো লাগার কথা নয়। ভালো না লাগলেও তারা তাদের বক্তব্য রেখেই যাবেন। যা তাদের উপর নবী-রাসূল সা:-এর অর্পিত দায়িত্ব। শরীরে বিন্দু পরিমাণ রক্ত থাকতে তারা সত্যিকারের কুরআন ও হাদিসের অনুসরণ থেকে সরে আসবেন না। তাদের বক্তব্য খুতবা কখনো কী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? দুনিয়াব্যাপী সব মসজিদে যেভাবে খুতবার ভাষণ অব্যাহত আছে, ঠিক একই নিয়মে খুতবার বক্তব্য মেহরাব থেকে প্রচারিত হবে, যত দিন জমিন ও আসমান থাকবে। জমিন আর আসমানের মালিক যিনি, যিনি আলো বাতাস দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারই ধারাবাহিক নিয়মনীতি-আদর্শ প্রচারের দায়িত্ব আছে ইমাম ও খতিবদের ওপর। এটি নিছক দুনিয়ার লোভ-লালসার কোনো দায়িত্ব নয়, এটি মহান আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত খতিবরা। যারা দেশ শাসন করছেন তারা যেন মসজিদ, মেহরাব, খতিবমুখী হন। তাহলেই বুঝবেন আসলে মসজিদের মেহরাব থেকে কী প্রচার হয়। মসজিদের বক্তব্য না শুনলে আপনি কখনো সঠিকভাবে ধারণা পাবেন না। অন্যের কথায় কান না দিয়ে নিজের কানে শুনে তারপর সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ দিন। তাহলেই সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে এবং নিতে সুবিধা হবে। নিজের কাজ নিজে করে খতিব ও ইমামদের তাদের দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা দিন, তাহলে মানুষ ও রাষ্ট্র আরো বেশি উপকৃত হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার

No comments:

Powered by Blogger.